বকশীগঞ্জে মহিলা কলেজের এডহক কমিটি নিয়ে তামাশা, মমতাজ বেগম পুনরায় সভাপতি মনোনীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, 5:52 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, 5:52 PM
বকশীগঞ্জে মহিলা কলেজের এডহক কমিটি নিয়ে তামাশা, মমতাজ বেগম পুনরায় সভাপতি মনোনীত
মোয়াজ্জেম হোসেন হিলারী, বকশীগঞ্জ প্রতিনিধি:
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খাতেমুন মঈন মহিলা ডিগ্রী কলেজের এডহক কমিটি নিয়ে তামাশা শুরু হয়েছে। ডিগ্রি কলেজের এডহক কমিটি নিয়ে চলছে নানান নাটকীয়তা।
০৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক অপসারণ কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটির এডহক কমিটির সভাপতি মনোনয়ন অতঃপর এডহক কমিটির সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্যের নাম পরিবর্তন করে নতুন সভাপতি মনোনয়ন এবং পুনরায় পূর্বের কমিটি পুনর্বহাল নিয়ে গত তিন মাসে পত্র চালাচালি করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এমন ঘটনাকে ‘তামাশা’ বলছেন কলেজটির শিক্ষকদের একাংশ ও অভিভাবক সমাজ। সর্বশেষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক মমতাজ বেগমকে পুনরায় এডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত করায় শিক্ষক কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সমাজের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মরহুম মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন সরকারের সুযোগ্য পুত্র শিক্ষানুরাগী মরহুম অধ্যাপক আবু নেওয়াজ মোঃ রশিদুজ্জামান ১৯৯৪ সালে বকশীগঞ্জের অদূরে পাখিমারা গ্রামে নারী শিক্ষার অগ্রতার জন্য তার পিতা মাতার নামে খাতেমুন মঈন মহিলা ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
খাতেমুন মঈন মহিলা ডিগ্রী কলেজে ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী মোঃ আবুল কালাম আজাদ।
২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত হন নিহারুন নাহার বিলকিস।
গত ০৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর ডক্টর ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নিহারুন নাহার বিলকিসকে অপসারণ করা হয় এবং প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের আগেই সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হন নিহারুন নাহার বিলকিস। তারস্থলে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পালন করেন বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহনা জিন্নাত।
এরই মধ্যে কলেজের অধ্যক্ষ বজলুল করিম শাহীন তালুকদারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নানা অনিয়ম, জালিয়াতী ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্তের দাবী জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন আব্দুল্লাহেল কাফি নামে জৈনক এক ব্যক্তি।
তিনি অভিযোগ করেন অধ্যক্ষ বজলুল করিম শাহিন আওয়ামীপন্থী এবং ফ্যাসিস্ট হাছিনা সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত। তিনি কলেজে নানা ধরনের অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতি করে আসছেন ব্যাংক হিসাব একক স্বাক্ষরে পরিচালনা করে নিয়মবহির্ভূত ভাবে কলেজের কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে দুটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এ সময় কলেজের ছাত্রীরা অধ্যক্ষের পক্ষে উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে মানববন্ধন করে। ছাত্রীরা অভিযোগ করেন তাদের অধ্যক্ষ কে জোরপূর্বক অপসারণ করার চক্রান্ত করছে একটি কুচক্রী মহল। কলেজের অধ্যক্ষ নিরাপত্তা চেয়ে বকশীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। ২৫ আগস্ট শিক্ষক কর্মচারীর একাংশ কলেজে কর্মবিরতি পালন করতে চাইলে অপর অংশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি এবং ধস্তাধস্তি হয়।
কলেজর অধ্যক্ষসহ ০৯ জনকে আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইদ্রিস আলী নামে একজনকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করে।
শিক্ষক কর্মচারীর একাংশ অধ্যক্ষ বজলুল করিম তালুকদারের অপসারণ চেয়ে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এর কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
২৮ আগস্ট অধ্যক্ষ মোঃ বজলুল করিম তালুকদারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারী করেন কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহনা জিন্নাত। কারণ দর্শানোর নোটিশে শিক্ষক-কর্মচারীগণের শৃংখলা ও আইনের ৫৩ ধারার উপধারা ২ মোতাবেক ১০ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব নোটিশ দাতার কার্যালয়ে দাখিল করতে বলা হয়।কলেজের অধ্যক্ষ বজলুল করিম তালুকদার বিধি মোতাবেক নোটিশের জবাব দাখিল করেন।
এ সময়ের মধ্যেই কলেজের দাতা সদস্য অধ্যাপক মমতাজ বেগমকে সভাপতি ও গোলাম রব্বানী কে বিদ্যোৎসাহী সদস্য, জনাব শামীমা কাইয়ুম কে হিতোষী সদস্য, মোহাম্মদ রোকনুজ্জামানকে শিক্ষক প্রতিনিধির সদস্য করে ০১/০৪/২০২৫ ইং তারিখ পর্যন্ত এডহক কমিটি মনোনয়ন করা হয়।
অধ্যাপক মমতাজ বেগম এডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়েই তার নিজস্ব ব্যক্তিগত অর্থায়নে কলেজের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন। যার মধ্যে ছাত্রী নিবাসের পিছনে সীমানা প্রাচীর মেরামত, লাইব্রেরীতে প্রয়োজনীয় বইয়ের যোগান, শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত খাবারের ক্যান্টিন ও ওয়াশ ব্লকের ব্যবস্থা, নামাজখানা, কম্পিউটার ল্যাব ও সিকিউরিটি রুমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহ যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন কিন্তু ০২/১২/২০২৪ তারিখে এডহক কমিটি সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্যের নাম পরিবর্তন করে পত্র জারি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
পত্রে উল্লেখ করা হয় এডহক কমিটির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক মমতাজ বেগম এর মনোনয়ন পরিবর্তন পূর্বক তদস্থলে সভাপতি হিসেবে জনাব এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য গোলাম রব্বানীর মনোনয়ন পরিবর্তন পূর্বক তদস্থলে আব্দুল্লাহেল কাফি কে আগামী ০১/০৫/২০২৫ তারিখ পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হল।
এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত এডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়ে গত ০৭ ডিসেম্বর কলেজে কমিটির সভায় সদস্যদের সম্মতিক্রমে কলেজের অধ্যক্ষ বজলুল করিম শাহিন তালুকদার কে বরখাস্ত করেন একই সময়ে কলেজের কৃষিশিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল মোকাদ্দেছকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন এবং সাত কার্যদিবসের মধ্যে কলেজের সকল দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর করার জন্য বজলুল করিমকে এক লিখিত পত্র প্রেরণ করেন। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে মর্মে উল্লেখ করেন। এতেই শুরু হয় বিতর্ক। লোকমুখে শোনা যায় নানান গুঞ্জন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক জানান আব্দুল্লাহ আল মুকাদ্দেছ স্যারের সাবজেক্ট হচ্ছে কৃষিশিক্ষা।
ডিগ্রী কলেজের প্রিন্সিপাল অথবা ভাইস প্রিন্সিপাল হতে হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সাবজেক্ট ডিগ্রি পর্যন্ত থাকতে হবে আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে তামাশা শুরু করেছে। একেক দিন একেক কমিটি দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ বে-আইনি নিয়ম বহির্ভূত ভাবে দাতা সদস্যদের বাদ দিয়ে এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে এডহক কমিটির সভাপতি মনোনয়ন করেছে। এ সময় তারা পূর্বের এডহক কমিটি পুনর্বহালের দাবি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সরকার রাসেল জানান যেহেতু প্রতিষ্ঠানের দাতা সদস্য রয়েছে এবং সে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি তাকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে সভাপতি করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নিয়ম বহির্ভূত। তিনি আরো বলেন দাতা সদস্য ব্যতীত বিদ্যোৎসাহী সদস্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই। পূর্বের কমিটিকে পুনর্বহালের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান।
সকলের দাবির প্রেক্ষিতে অবশেষে ১৮/১২/২০২৪ তারিখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিদর্শক আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয় মহিলা ডিগ্রী কলেজের এডহক কমিটির বর্তমান সভাপতি এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত এর মনোনয়ন পরিবর্তন পূর্বক তদস্থলে অধ্যাপক মমতাজ বেগমকে এডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে আগামী ০১/০৪/২০২৫ তারিখ পর্যন্ত মনোনয়ন দেওয়া হল।
কলেজের এডহক কমিটি নিয়ে এমন বাদ-বহাল খেলায় বিব্রত কলেজটির অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তারা বলছেন কমিটি নিয়ে এমন ঘটনা প্রমাণ করে কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়ন নয়, কোন মহলের ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্যে রয়েছে। এতে বকশীগঞ্জের একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। এ সময় তারা কলেজের দাতা সদস্য অধ্যাপক মমতাজ বেগমের কমিটির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে কলেজটির সাবেক এক শিক্ষক বলেন কমিটি নিয়ে এমন তামাশার খেলায় আমরা বকশীগঞ্জ বাসী বিব্রত। শিক্ষকরা পাঠদান করবেন নাকি কমিটি কমিটি খেলা করবেন এমন প্রশ্নও করেন তিনি।
এডহক কমিটি ও বহিষ্কারের বিষয়ে জানতে চেয়ে অধ্যক্ষ বজলুল করিমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন আমি বহিষ্কৃত লোক সভাপতির অনুমতি ব্যতীত কিছু বলতে পারব না।
কমিটি নিয়ে এমন ‘তামাশা’ বিষয়ে জানতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক কে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।